Script:

কেলেঘাই নদীর জলজ বাস্তুতন্ত্রের সংরক্ষণ- একটি সচেতনতামূলক নিবিড় প্রচেষ্টা

ড. মৃন্ময় মণ্ডল, ড. নীলাঞ্জনা দাস চ্যাটার্জী, শুভজিত জানা, কৃষ্ণগোপাল চক্রবর্তী, শান্তনু অধিকারী

প্রাচীনকাল হতে কেলেঘাই নদী ছিল তীরবর্তী সমাজের কাছে জীবন জীবিকার প্রধান উৎস। দৈনন্দিন জীবনে এই নদী তার অপরিহার্য উপাদানগুলিকে সহজলভ্য করে রেখেছিল। সঠিক এবং ভারসাম্য বাস্তুতন্ত্রই ছিল এই  সহজলভ্যতার প্রধান কারণ। জনবিস্ফোরণ ও সভ্যতা বিবর্তনের আধুনিকীকরণ ধীরে ধীরে নদীর বাস্তুতন্ত্রের উপর কঠিন আঘাত এনেছে। মনুষ্যসভ্যতার সাময়িক লোভ ও লালসায় জর্জরিত আজ এই নদীর বাস্তুতন্ত্র। তীরবর্তী বাসিন্দাদের কখনো ইচ্ছায় বা কখনো নিরুপায়তায় ক্রমান্বয়ে হারিয়ে যাচ্ছে নদীর মৌলিক উপাদানগুলি। যার প্রভাব পড়তে শুরু করেছে আর্থ-সামাজিক পরিবেশের উপর। এই অসহায়তার ছবি তীরবর্তী মনুষ্যকুলের কাছে  স্পষ্ট হতে শুরু করেছে। এই ভয়াবহতার পূর্বাভাসকে সামনে রেখে, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে একটি  সুস্থ স্বাভাবিক জীবনের লক্ষ্যে কেলেঘাই নদীর জলজ বাস্তুতন্ত্রের সংরক্ষণ ভীষণ প্রয়োজন বোধ করি।

বাস্তুতন্ত্র বিঘ্নিত হওয়ার কারণ

বিশ্বব্যাপী প্রত্যেকটি নদীর বাস্তুতন্ত্র আজ আধুনিক সভ্যতার কালগ্রাসে জর্জরিত।  নদীর বাস্তুতন্ত্র বিঘ্নিত হওয়ার পেছনে সাধারণ কারণ গুলি প্রায় একই ধরনের। তবে অঞ্চলভেদে নদীকেন্দ্রিক বাস্তুতন্ত্র বিনষ্ট হওয়ার কারণ গুলি  বিশেষ বিশেষ হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে কেলেঘাই নদীর বাস্তুতন্ত্র বিনষ্ট হওয়ার পেছনে বেশ কয়েকটি বিশেষ কারণ  বিদ্যমান। যেমন-  

১। গতিপথের পরিবর্তন

টিশ শাসন থেকে কেলেঘাই নদীর গতিপথের পরিবর্তন ঘটেছে। এই নদীর পুরানো প্রবাহ পথকে আবদ্ধ করে,  জোরপূর্বক পূর্বমুখে প্রবাহিত হতে বাধ্য করা হয়েছে।  ফলে নদীর মধ্যবর্তী অংশে বন্যা ভয়াবহ আকার ধারন   করে। এই ঘটনা স্থিতিশীল বাস্তুতন্ত্রের উপর ব্যাপক প্রভাব ফেলে।   যার প্রভাব সদূরপ্রসারী হয়,  নদী তীরবর্তী এলাকার বাসিন্দাদের আর্থ সামাজিক জীবনের উপর।

২০২১ সালের বন্যা কবলিত এলাকার চিত্র। গোপীনাথপুর- নারায়ণগড় ব্লক, নৈপুর- পটাশপুর ব্লক।

২। অববাহিকার জলাভূমি গুলির বিচ্ছিন্নকরণ

এই নদীর অববাহিকায় প্রচুর জলাভূমির অবস্থান ছিল। ঐ জলাভূমি গুলো নদীর জলজ বাস্তুতন্ত্রের উপাদান ধারাবাহিক ভাবে জোগান দিত। কিন্তু বর্তমানে জলাভূমি গুলি বিভিন্ন বাঁধ দ্বারা নদীর মূল স্রোতের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন  হয়েছে। যার ফলে নদীর খাদ্য শৃঙ্খলের ব্যাপক অভাব ও পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়।

কেলেঘাই অববাহিকায় জলাভূমি। বুলাকিপুর মৌজা, তালাডিহা মৌজা

৩। নদী অববাহিকায় বাণিজ্যিক মাছ চাষের ব্যবস্থা

বিংশ শতাব্দীর শুরু থেকে কেলেঘাই অববাহিকার নীচু জলাভুমিগুলিকে কৃত্রিম বাঁধ দ্বারা আবদ্ধ করে   বানিজ্যিকভাবে মাছ চাষ শুরু হয়েছে। এই প্রকল্প ব্যাপক ভাবে নদীর নিজস্ব বাস্তুতন্ত্রকে বিঘ্নিত করছে। এতে সাময়িক মুনাফার সংস্থান হলেও সামগ্রিকভাবে সুদূরপ্রসারী ক্ষতির মুখে পড়বে প্রান্তিক বাসিন্দারা। এই প্রকল্পের  জন্য নদী হারাচ্ছে তার নিজস্ব জীববৈচিত্র। স্থানীয় বাজার থেকে হারিয়ে যাচ্ছে সুলভ ও সহজলভ্য মাছ। যার ফলে  এক শ্রেণির প্রান্তিক গরিব মানুষের খাদ্যের তালিকা থেকে বাদ পড়ছে নদীর মাছ এবং এই সংকট আগামী দিনে গভীর আকার ধারন করবে। শুধু তাই নয় এই ধরনের মাছ চাষে প্রচুর পরিমানে নদীর ও ভৌমজল ব্যবহার করা হয় যা ভবিষ্যতে পানীয় জল সঙ্কটের ইঙ্গিত বহন করে।

বাণিজ্যিক মৎস্য ক্ষেত্র। গোকুলপুর মৌজা।

৪। নদীর উভয় বকচরে অনিয়ন্ত্রিত কৃষিব্যবস্থা

মৌসুমি বর্ষার শেষ থেকে শুরু পর্যন্ত সময়ে, নদীর উভয় বকচরে চলে নানান ধরনের চাষাবাদ। এই চাষাবাদ পদ্ধতি উত্তরাধিকার সূত্রে বহমান। কিন্তু সমস্যা হল বর্তমানে এই চাষের জমিতে মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক সার ও  কীটনাশকের ব্যবহার। ক্রমান্বয়ে এর ব্যবহার উত্তরোত্তর বেড়ে চলেছে। এর ফলে নদীর জলজ বাস্তুতন্ত্রের নীচের  খাদ্য স্তরে (ছোট মাছ) ব্যাপক ভারসাম্য বিনষ্ট হয়। আবার অতিরিক্ত মুনাফার তাগিদে জমিগুলিতে লাইলনের নেট দিয়ে ঘেরা হয়। জমির উৎপাদন শেষ হলে ঐ পরিত্যাক্ত নেটগুলি নদীর জীববৈচিত্র ক্ষয়ে প্রত্যক্ষভাবে প্রভাব ফেলে।   

৫।   নদীর আড়াআড়ি বেড়া (বাঘাল/ঘটি) দেওয়া 

বাঘাল একটি প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী মাছ ধরার পদ্ধতি। নদী পার্শ্ববর্তী ধীবর সম্প্রদায়ের জীবন জীবিকার সাথে যার প্রত্যক্ষ যোগ। কিন্তু বর্তমানে এই বাঘালের সংখ্যা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাছে এবং এটি তৈরির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে  আধুনিক সরঞ্জাম যেমন প্ল্যাস্টিক পেপার, লাইলনের নেট, ফাইবারের সিট।  এর ফলে নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ বিঘ্নিত হয় তৎসঙ্গে নদীতে আগাছা, কচুরিপানা ও নানান ধরনের অপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের স্থিতাবস্থা ভীষণ ভাবে পরিলক্ষিত হয়। প্রতি বছর এই বাঘালগুলি থেকে মাত্রাতিরিক্ত মাছ ধরার ফলে নদী থেকে মাছের বৈচিত্র ব্যাপক ভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে।    

আড়াআড়ি বাঁশের বেড়া- নদীতে মাছ ধরার এক প্রাচীন কৌশল। ঘাটি/বাঘাল, কনকপুর মৌজা। 

৬। অতিরিক্ত সাঁকো

বর্তমানে নদীর উভয়পার্শে যাতায়াতের সুবিধার জন্য ঘন ঘন সাঁকো তৈরি নদীর স্বাভাবিক প্রবাহকে রুদ্ধ করেছে। ঐ সাঁকোগুলি কংক্রিটের রাস্তা দ্বারা যুক্ত করা যা নদীবক্ষের নিজস্ব বাস্তুতন্ত্রকে অস্থির করে তুলেছে।

নদী পারাপারের সাঁকো। তেঁতুলিয়া ঘাট/বেহুলার খেয়া।

৭। জলজ স্থানীয় গাছগুলির বিলুপ্তি

চাষাবাদের জমি অধিগ্রহণ, রাস্তা তৈরি, নদীবাঁধ সংস্কার ইত্যাদির কারণে বা অকারণে জলজ স্থানীয় গাছগুলির বিলোপসাধন নদীর সামগ্রিক বাস্তুতন্ত্রকে ব্যাপক ক্ষতির দিকে এগিয়ে নিয়ে গেছে।

হিজল গাছ। নদীর জলজ বাস্তুতন্ত্রে ব্যাপক ভূমিকা পালন করে

৮। অববাহিকার কেনেলগুলির পরিত্যাক্ত অবস্থা

কেলেঘাই নদীর সম্পূর্ণ অববাহিকা জুড়ে সংযুক্ত কেনেলগুলি সারা বছর ধরে নদীর বাস্তুতন্ত্রের রসদ যুগিয়ে এসেছে। কিতু বেশ কয়েক দশক ধরে এই কেনেল গুলি পরিতক্ত। কোথাও কেনেল গুলির চিহ্ন সম্পূর্ণভাবে নিশ্চিহ্ন, আবার কোথাও মনুষ্যসমাজের জবরদখলকৃত। যার ফলে নদীর বাস্তুতন্ত্রে ব্যাপক ঘাটতি দেখা দিচ্ছে।   

প্রতিকারের পদক্ষেপ   

কেলেঘাই নদীর উৎস থেকে তার মোহনা পর্যন্ত অববাহিকা অঞ্চলে সমীক্ষাই ছিল এই নদীর বাস্তুতন্ত্র বোঝার প্রথম ধাপ। সমীক্ষায় দেখা যায় পশ্চিম মেদিনীপুরের পোক্তাপোল থেকে  পূর্ব মেদিনীপুরের ঢেউভাঙ্গা পর্যন্ত নদীর জলজ বাস্তুতন্ত্র ভীষণ ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ। পরিকল্পনাহীন সভ্যতার উন্নয়ন ও সমাজের উদাসীন মনোভাব প্রত্যক্ষভাবে নদীর বাস্তুতন্ত্রকে গভীর সংকটের দিকে ধাবিত করছে। পরিকল্পনাগুলির ত্রুটি বিচ্যুতি প্রশাসনের কাছে পৌঁছে দিতে এবং সর্বোপরি সাধারণ বাসিন্দাদের উদাসীনতাকে দূরীভূত করতে বেশ কয়েকটি পদক্ষেপ আমরা গ্রহণ করি।

প্রথম এবং প্রধান পদক্ষেপ হিসাবে আমরা এলাকায় সচেতনতামূলক প্রচার চালাই, যা আজো চলমান। বেশ কিছু পরিবেশ সংগঠনের সহায়তায় আঞ্চলিক বাসিন্দাদের সংগঠিত করে নদীর বাস্তুতন্ত্রের গুরুত্ব বোঝানোর চেষ্টা চলে সারা বছর ধরে। তবে নদীর বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য বজায় রাখতে হলে যেমন সচেতনতামূলক প্রচার প্রয়োজন তেমনি প্রয়োজন প্রশাসনিক সহযোগিতা। তার দরুন চলে প্রশাসনের দরবারে বিষয়গুলি নিয়ে গভীর আলোকপাত। বিষয়গুলি এই রকম-

১। নদী অববাহিকার জলাভূমিগুলিকে পুনরায় আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা।  নদী ও জলাভূমিগুলির সংযুক্ত কেনেলগুলিকে সংস্কারের মাধ্যমে নদীর নিজস্ব বাস্তুতন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত করা।

২। নদীর উপত্যকায় জলজ বৃক্ষের ছেদন একেবারে বন্ধ করে, পুনরায় নতুন করে ঐ বৃক্ষগুলি রোপণ ও রক্ষণাবেক্ষণ করা।

৩। সামাজিক বনসৃজনের মাধ্যমে নদীবাঁধ গুলিতে হারিয়ে যাওয়া স্থানীয় বৃক্ষের চারা রোপণ ও রক্ষণাবেক্ষণ করা।

৪।  প্রশাসনিক দিক থেকে নদী মধ্যস্থিত বাঘালগুলির সংখ্যা কমিয়ে বছরে নির্দিষ্ট সময় থেকে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত মাছ ধরার পারমিশান দেওয়া।  এবং ঐ বাঘালগুলি যেন কোনভাবেই নদীর স্বাভাবিক প্রবাহকে বিঘ্নিত না করে সে ব্যাপারে নজরদারী চালানো।

৫। নদী মধ্যস্থিত কৃষিজমি জমিগুলিতে যাতে ব্যাপক ভাবে রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহার না করে জৈব পদ্ধতিতে চাষাবাদ করা যায় , সেই ব্যাপারে কৃষকদের উৎসাহিত করা।

৬। প্রশাসনিক সহায়তায় প্রতি বছর নদীতে জীববৈচিত্রের ভারসাম্য রক্ষার্থে স্থানীয় মাছের চারা নদীতে ছাড়তে হবে।

৭। বাণিজ্যিক মাছ চাষের প্রকল্পগুলি যেন কোনভাবেই নদী অববাহিকার জলাভূমি ও কৃষিজমির উপর না গড়ে ওঠে সে বিষয়ে প্রশাসনের কঠিন নজরদারী প্রয়োজন।

৮। কেলেঘাই নদীর আদি গতিপথকে সংস্কারের মাধ্যমে নদীর স্বাভাবিক প্রবাহকে ফিরিয়ে আনা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যা তীরবর্তী বাসিন্দাদের বন্যার বিভীষিকা থেকে অনেকখানি মুক্ত করবে ও আর্থ সামাজিক দিক থেকে স্বনির্ভর করে তুলবে।

নদী অধ্যুষিত গ্রামে পথসভা করে বাসিন্দাদের আমরা বিভিন্ন স্থানীয় প্রজাতির জীবের বাস্তুতন্ত্রে তাদের ভূমিকা কতখানি তা বোঝানোর চেষ্টা চালাই। বিশেষ করে নানা প্রজাতির সাপ, কচ্ছপ, মাছেরা বাস্তুতন্ত্রে কি ভূমিকা পালন করে ও এই প্রজাতিগুলির বিলুপ্তি ঘটলে জনজীবন কি কি অসুবিধার সম্মুখীন হবে সে বিষয়ে সচেতনতা গড়ে তুলি। স্থানীয় বাজারগুলিতে লুপ্তপ্রায় প্রাণীগুলির বিক্রির অসাধুচক্র যাতে রমরমিয়ে না ওঠে, সে ব্যাপারেও জনগণকে এগিয়ে আসার আহ্বান করি।

কেলেঘাই অববাহিকায় জনসচেতনতা মূলক প্রচার

সাফল্য

বিগত দুই বছরের এই প্রচেষ্টায় সাফল্যের মুখ দেখেছি আমরা। অববাহিকার বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রান্তিক মানুষেরা এই বিষয়ে সমস্যার কথা আমদের কাছে তুলে ধরছেন। বর্তমানে গ্রামীণ বিভিন্ন উৎসবে ও মেলায় এই বিষয়ে আলোচনার জন্য আমাদের আহ্বান জানানো হয়। বাস্তুতন্ত্র বিষয়ক আলোচনা গ্রামীণ মানুষেরা আগ্রহের  সহিত শুনেন। বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে মতামত বিনিময় করেন। শুধু তাই নয় নদীর লুপ্তপ্রায় প্রাণীগুলিকে আজ আর ব্যাপক ভাবে হত্যা করা হয় না বরং তাদের পুনরায় নদীর বাস্তুতন্ত্রে ফিরিয়ে দেওয়ার খবর বিভিন্ন এলাকা থেকে আমরা পাই। কিন্তু দুঃখের বিষয় আজো বেশ কিছু অসাধু ব্যবসায়ী মুনাফার লোভে নিরীহ প্রজাতিগুলির হত্যা লিলায় জড়িয়ে আছে।  তবে এলাকাভিত্তিক সচেতনতা বৃদ্ধির ফলে প্রান্তিক মানুষেরা তাদের নিজস্ব এলাকায় স্থানীয় বড় গাছের ব্যাপারে যত্নশীল হয়েছে। কারণ দেখা গেছে বিভিন্ন এলাকায় ঐ সমস্ত গাছ কাটার, অসহায় লুপ্তপ্রায় প্রাণীগুলিকে পরিবেশ সংগঠনের হাতে তুলে দেওয়া, জলাভূমি গুলিকে অধিগ্রহণ করে বাণিজ্যিক মাছ চাষের প্রকল্প তৈরির বিরুদ্ধে জনপ্রতিরোধ গড়ে উঠছে।       

Share the article

0 Comments